@লেখক
রাজশেখর বসু ছিলেন একাধারে বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা। তাঁর জন্ম ১৮৮০ সালের ১৬ মার্চ, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে। তাঁর পিতার নাম চন্দ্রশেখর বসু এবং মাতার নাম লক্ষ্মীমণি দেবী। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল নদীয়া জেলার বীরনগর (উলা) গ্রামে। শৈশবে দ্বারভাঙ্গায় বড় হওয়ার সুবাদে রাজশেখর বাংলা ভাষার পাশাপাশি হিন্দিতেও পারদর্শী ছিলেন।
ছাত্রজীবনে তিনি অসম্ভব মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৮৯৫ সালে দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করার পর ১৮৯৭ সালে পাটনা কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ পাস করেন। তখন এম.এস-সি কোর্স না থাকায় তিনি রসায়নে এম.এ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯০২ সালে রিপন কলেজ থেকে বি.এল পাশ করলেও আইন ব্যবসায় বেশি দিন মনোযোগী হতে পারেননি।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯০৩ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস-এ রসায়নবিদ হিসেবে। স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে এসে তিনি বিজ্ঞানের চর্চা ও কোম্পানির পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯০৪ সালে তিনি কোম্পানির পরিচালক পদে উন্নীত হন এবং আমৃত্যু উপদেষ্টা ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনায়ও তিনি ছিলেন অনন্য।
সাহিত্যের জগতে রাজশেখর বসু ছিলেন ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামের অধিকারী। ১৯২২ সালে ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ ব্যঙ্গরচনা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর থেকে রম্যরচনা, বিদ্রুপকাহিনি ও ব্যঙ্গাত্মক গল্পের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর ব্যঙ্গরচনাগুলি পাঠকদের মনে হাস্যরসের ঝর্ণা বইয়ে দিত। এছাড়া তিনি কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-র অনুবাদ করে ধ্রুপদি সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালিকে পরিচয় করিয়েছেন।
বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি সাধনে রাজশেখর বসুর অনন্য অবদান ‘চলন্তিকা’ অভিধান। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত এই অভিধান বাংলা ভাষার ব্যবহারিক অভিধান হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ২১টি। তাঁর লেখা গল্পগুলির চিত্রাঙ্কন করেছিলেন তাঁর বন্ধু চিত্রশিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেন।
রাজশেখর বসু সমাজসেবায়ও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মানসিক রোগের চিকিৎসায় সাহায্যার্থে তাঁর ভাই গিরীন্দ্রশেখর বসুর হাতে লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে তিনি জমি ও অর্থ দান করেছিলেন।
তাঁর কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে, ভারত সরকার পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৫৫ সালে আনন্দীবাঈ গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
একাধারে সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও সমাজসেবী এই বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব ১৯৬০ সালের ২৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনকর্ম চিরকাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঋদ্ধ করে রাখবে।
বার পড়া হয়েছে
বইসমগ্র